বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহাসিক জেলা হলো হবিগঞ্জ। পাহাড়-টিলা, নদী-নালা, বনভূমি ও প্রাকৃতিক জলপ্রপাত ছাড়াও এই জেলার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। হবিগঞ্জ শহর ও তার আশপাশে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানগুলো বছরের পর বছর পর্যটকদের আকৃষ্ট করে আসছে। এই জেলায় রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ি, রোমাঞ্চকর ট্রেকিং স্পট, নিরিবিলি চা-বাগান এবং লোকজ ঐতিহ্যের নিদর্শন। যারা প্রকৃতি ও ইতিহাস ভালোবাসেন, তাদের জন্য হবিগঞ্জ হতে পারে একটি আদর্শ ভ্রমণ গন্তব্য।
এই লেখায় আমরা হবিগঞ্জ জেলার সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরবো।
১. শায়েস্তাগঞ্জ চা-বাগান: সবুজে ঘেরা এক শান্তির জগত
হবিগঞ্জ জেলার শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত এই চা-বাগানটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সুন্দর চা-বাগান। সারি সারি চা-গাছের মাঝে হাঁটা, শ্রমিকদের জীবনযাত্রা দেখা এবং তাজা চা-পাতা চেয়ে চা খাওয়া – এই সবকিছু মিলিয়ে ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা তৈরি করে। প্রকৃতিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের জন্য জায়গাটি এক আদর্শ স্থান।
২. বাহুবল সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান: জীববৈচিত্র্যে ভরপুর রেইন ফরেস্ট
বাহুবল উপজেলায় অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল যা ছোট ছোট সাতটি ছড়ার কারণে এই নাম পেয়েছে। এখানে রয়েছে হরিণ, বনমোরগ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, প্রজাপতি এবং বিরল উদ্ভিদ। এটি ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং এবং নেচার ক্যাম্পিংয়ের জন্য দারুণ উপযোগী। এছাড়া উদ্যানের মাঝে চমৎকার ট্রেইল রয়েছে, যা ভ্রমণকারীদের প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে তোলে।
৩. রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য: বন ও বন্যপ্রাণীর মিলনক্ষেত্র
রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের অন্যতম বড় ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। চা-বাগান ঘেরা টিলার মধ্যে অবস্থিত এই বনাঞ্চলে রয়েছে গিবন, মায়া হরিণ, লজ্জাবতী বানর, এবং বহু প্রজাতির পাখি ও গাছপালা। ট্রেকিং ও রোমাঞ্চপ্রেমীদের জন্য এটি একটি দারুণ গন্তব্য। এখানে রাত কাটানোরও ব্যবস্থা রয়েছে বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে।
৪. হবিগঞ্জ রাজবাড়ি: ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য
হবিগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই প্রাচীন রাজবাড়িটি ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত। এটি এক সময় জমিদার ও স্থানীয় রাজাদের বাসস্থান ছিল। স্থাপনাটি দৃষ্টিনন্দন হলেও বর্তমানে কিছুটা জরাজীর্ণ, তবে ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এটি এক অসাধারণ স্থান। আপনি চাইলে রাজবাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখতে পারেন এবং পুরনো দিনের রাজকীয়তার ছোঁয়া অনুভব করতে পারেন।
৫. বানিয়াচং – বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম
বানিয়াচং শুধু হবিগঞ্জ নয়, গোটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ স্থান। এটি বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামে রয়েছে অনেক পুরাতন মসজিদ, ঐতিহাসিক মন্দির, এবং হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বর্ষাকালে হাওর পানিতে ভরে গেলে নৌকাই হয় প্রধান বাহন। হাওরের মাঝে নৌকায় ভ্রমণ এবং গ্রামের লোকজ সংস্কৃতি দর্শন করতে চাইলে বানিয়াচং ভ্রমণ অবশ্যই করতে হবে।
৬. লাখাই হাওর – অতিথি পাখির আবাসস্থল
শীতকালে হবিগঞ্জের লাখাই হাওর হয়ে ওঠে অতিথি পাখিদের মিলনমেলা। হাজার হাজার অতিথি পাখির কলকাকলিতে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতিপ্রেমী ও পাখিপ্রেমীদের জন্য এই হাওর এক স্বর্গরাজ্য। নৌকায় চড়ে পাখি দেখা এবং হাওরের স্নিগ্ধ পরিবেশে দিন কাটানো এখানে অন্যতম আকর্ষণ।
৭. সুলতানপুর জমিদার বাড়ি – পুরনো দিনের রাজকীয়তার ছোঁয়া
সুলতানপুর ইউনিয়নের এই জমিদার বাড়িটি আজও কালের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জমিদারদের স্থাপত্যশৈলী, বিশাল উঠান ও পুরনো দিনের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ভ্রমণকারীদের কাছে আগ্রহ জাগায়। বাড়ির ভেতরে এখনও কিছু অংশ দেখা যায় যা মেরামতের অভাবে ধ্বংসপ্রায়।
৮. নবীগঞ্জের কুশিয়ারা নদী – নদীভিত্তিক জীবনের এক প্রতিচ্ছবি
নবীগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখা, নৌকায় ঘুরে বেড়ানো, এবং জেলেদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ – সবই এখানে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দেয়। যাদের শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির ছায়ায় সময় কাটাতে ভালো লাগে, তাঁদের জন্য এই জায়গা আদর্শ।
৯. নবীগঞ্জের হাওর অঞ্চল – বর্ষাকালের বিস্ময়
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকায় বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চল রয়েছে যা বর্ষাকালে পরিণত হয় বিশাল জলরাশিতে। বর্ষার মৌসুমে নৌকা চালিয়ে হাওরের মাঝ দিয়ে গ্রামের মাঝে পৌঁছানো এক দারুণ অভিজ্ঞতা। গ্রামীণ জীবন, কাদামাটি ও ভেসে থাকা ঘরবাড়ি দেখে আপনি এক অন্যরকম বাংলার রূপ আবিষ্কার করবেন।
১০. কাঠারিয়া শাহী ঈদগাহ – ধর্মীয় ইতিহাসের নিদর্শন
এই ঈদগাহ মাঠটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ ঈদগাহ হিসেবে পরিচিত। এখানে একসাথে লাখো মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করেন। ঈদ ছাড়া অন্যান্য সময়ে জায়গাটি ফাঁকা থাকে, তবে ধর্মীয় গুরুত্ব ও ঐতিহ্যগত দিক থেকে এটি এক দর্শনীয় স্থান।
🧭 কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে সহজেই হবিগঞ্জ পৌঁছানো যায়। শায়েস্তাগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সিএনজি, বাস বা প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়া যায়। বর্ষাকাল ও শীতকাল – উভয় মৌসুমেই হবিগঞ্জ ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
✨ শেষ কথা
হবিগঞ্জ শুধু একটি জেলা নয়, এটি বাংলাদেশের একটি পর্যটন সম্ভার। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য, ইতিহাস, ধর্মীয় ও লোকজ সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। আপনি যদি শান্ত পরিবেশে প্রকৃতিকে অনুভব করতে চান এবং পাশাপাশি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেতে চান – তাহলে হবিগঞ্জ হতে পারে আপনার পরবর্তী গন্তব্য।